আশফাক চৌধুরী
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমি ও আমার ছোটমামা সেখানে ছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ সরাসরি শুনেছি। আমরা ছিলাম রমনা পার্কে, রাস্তার অপর পারে যেখান থেকে মঞ্চ থেকে খুব বেশি দূরে ছিলোনা। আমরা তরুণ এবং উত্তেজিত ছিলাম। ভাষণ শেষে আমরা বাসাবোয় ফিরে গেলাম যেখানে আমরা থাকতাম। আমাদের বাড়ী 'হীরাঝিল' শহরের শেষ প্রান্তে ছিল, এর পর ছিলো কেবল একটা 'ঝিল'। আমরা রাস্তায় পাশে একটা বড় গোল বারান্দাওলা বাড়ীর দোতলায় থাকতাম। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। আমরা আমাদের বেশিরভাগ সময় বারান্দায় রাজনীতি নিয়ে কথা বলে কাটাতাম। আমাদের দেয়ালে 'মুজিব ভাই' এর অনেক ছবি লাগানো ছিল। আমরা আমাদের বাড়ীর উপরে হাতে তৈরি সবুজ, লাল এবং হলুদ পতাকা লাগিয়ে ছিলাম, আশেপাশের সব বাড়ীর ছাদের উপরেই তা ছিল।
২৫শে মার্চ
সেদিন সন্ধ্যায় ছোটমামা বাড়ী ফিরে যেতে চাইলেন। আমি তাকে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিলাম। রাতের সেই ঢাকা-সিলেট ট্রেনটি ছিল শেষ ট্রেন, এর পরের কয়েক মাস ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ছোটমামা অল্পের জন্য ঢাকায় আটকে পড়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
মাঝরাতে আমরা গোলাবারুদ, মেশিনগান ইত্যাদির শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। পাক আর্মি তার নিজের দেশের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা নির্বিচারে নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করা শুরু করে। পাক আর্মির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন যা আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। লোকজন সর্বত্র চিৎকার করছিল। কিছু লোক আমাদের সামনের রাস্তায় আতঙ্কে দৌড়াচ্ছিল আর চিৎকার করছিল "পালিয়ে যান, পালান, তারা পুরো শহর পুড়িয়ে দেবে, তারা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে, জীবন নিয়ে পালান"। আমার বাবা আমাদের দরজা না খোলা এবং লাইট না জ্বালাতে বলেন। জানালা দিয়ে আমরা রাজারবাগ এবং অন্যান্য জায়গায় আগুনের শিখা দেখতে পেতাম। আমরা অনুভব করেছি বুলেটগুলি যেন আমাদের কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। আমরা পরের দিন বেঁচে থাকব বলে মনে হয়নি।
২৬শে মার্চ ১৯৭১
কাছের মসজিদ থেকে ফজরের 'আজান' ভেসে এলো। সারারাত গোলাগুলি শোনার পর এ যেন আজান নয়, আশ্বাসের বানী। লোকজন ভয়ে ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। চারদিকে অনেক বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা। ঠিক কী ঘটছে তা কেউ বুঝতে পারছিলোনা।
সব বাড়ীর ছাদে হাতে বানানো লাল সবুজ হলুদ রঙের হাতে বানানো বাংলাদেশের পতাকা লাগানো ছিলো। আমাদের ছাদেও আমার নিজের হাতে বানানো পতাকা ছিলো। আতংকে সবাই ছাদ থেকে পতাকা নামিয়ে ফেললো। আমি ও আমার ছোটভাই যে রুমে থাকতাম তার সারা দেয়ালে পত্রিকা থেকে কাটা শেখ মুজিবের ছবি লাগানো ছিলো, ওগুলো সব নামিয়ে পুড়িয়ে ফেললাম।
বাসাবো তখন শহরের বাইরে ছোট একটা আবাসিক এলাকা এবং আক্ষরিক অর্থেই আমাদের বাড়ীর পরই ঢাকার সীমানা, শুধুই একটা ঝিল আর কিছুই ছিলোনা আমাদের বাড়ীর নাম ছিলো হীরাঝিল। শহরে যাবার সাহসও কারো হচ্ছিলোনা। রেডিও পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের খবর আমাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে। চারিদিকে হতাশা, মনে হয়েছে বাঙালি হিসাবে আমরা শেষ হয়ে গেছি।
শুধু একজন বিবিসির সাংবাদিক সায়মন ড্রিং ও এপির একজন ফটো জার্নালিস্ট হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের ছাদে লুকিয়েছিলেন। পাক আর্মি তাদের খুঁজে পায়নি। হোটেলের বাঙ্গালী কর্মচারীরা তাদের লুকিয়ে রেখেছিলো। ওরা সায়মনকে একটা হোটেলের বেকারী ভ্যানে তুলে দেয়। সায়মন ঐ ভ্যানের জানলা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা শহর ঘুরে নিজের চোখে দেখে হত্যাযজ্ঞের রিপোর্ট তৈরি করেন। কিন্তু তা বাইরে পাঠাবার কোন উপায় ছিলোনা। দুদিন পর সায়মন কোনভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান, সেখান থেকে ব্যাংকক গিয়ে ৩০ তারিখ বিবিসিতে তার রিপোর্ট পাঠালে সারা পৃথিবীতে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
হটাত সারা শহরে মানুষের মুখে মুখে একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো, চট্টগ্রাম রেডিও ধরো।
চট্টগ্রাম থেকে তখন রেকর্ড করা সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বার বার বাজানো হচ্ছিলো। অনেক
চেষ্টা করে ধরতে পারলাম, খুব খারাপ সিগনাল, ক্ষীণ সে আওয়াজ, কিন্তু জানতে পারলাম
চট্টগ্রামে বাঙ্গালী সেনা সদস্যরা বিদ্রোহ করেছে ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু
হয়েছে। জিয়ার সেই কন্ঠস্বর "আমি
মেজর জিয়া বলছি" আমাদের কানে বজ্রের আওয়াজের মতো বাজলো। সে কি দারুণ
অনুভূতি! আমরা আবার উজ্জিবিত অনুভব করলাম, মনে হল আমরা শেষ হয়ে যাইনি। সেদিন যারা সে ভাষণ শুনেছিল সে শিহরণ সে
অনুভুতি কখনই তারা ভুলবে না।
এপ্রিল - মহাপ্রস্থান
দু'দিন পর
যখন কারফিউ উঠানো হলো, আমরা দেখলাম লোকজন
শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাসাবোতে থাকতাম। যেহেতু বাসাবো শহরের প্রান্তে
ছিল এবং কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল এবং তখনও
সেখানে সামরিক উপস্থিতি ছিল না তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি একটা জনপ্রিয় পালিয়ে যাবার পথ ছিল। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য
রেডিওই ছিল একমাত্র
মাধ্যম। আমরা ভয়াবহ সংবাদ এবং চরম বর্বরতা এবং গণহত্যার খবর পেতে শুরু করি। আমরা শহরে আমাদের
আত্মীয়দের নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমাদের এক বোন তার পরিবার নিয়ে শুকরাবাদ থেকে নিরাপত্তার জন্য আমাদের বাড়ীতে চলে এলেন। আতঙ্ক এমন পর্যায়ে ছিল যে একদিন আমরা আমাদের বারান্দার মেঝেতে বসে গল্প করছিলাম যাতে
আমাদের রাস্তা থেকে দেখা না যায়। হঠাৎ একটা রিকশার টায়ার ফেটে যাওয়ার শব্দ হল। এক মুহূর্তে বারান্দা ফাঁকা!
শীঘ্রই মনে হল যে খুব বেশি দিন ঢাকায় থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমার বাবা এবং আরও কিছু আত্মীয়স্বজন সহ প্রায় ৩০০ মাইল দূরে সিলেটের গ্রামের বাড়ীতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে কীভাবে যাবেন, কারও ধারণা ছিল না; কোনও ট্রেন, বাস বা বিমান চলছিল না। আমাদের এক মামা, ধানমন্ডিতে বাস করতেন সেই ঝামেলার সময়েও আমাদের খোঁজ নিতে বাসাবো আসার বিরাট ঝুঁকি নিতেন। তাঁর দুই ছোট ভাই পাক আর্মিতে থাকায় তিনি বিশেষভাবে উচ্চ ঝুঁকিতে ছিলেন। এর মধ্যে একজন মেজর জিয়ার সাথে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং অন্য একজন পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন।
আমার মামার একজন হিন্দু ভাড়াটিয়া ছিলেন, যিনি স্বামীর সাথে তার বাড়ীর উপরের তলায় থাকতেন। তিনি ছিলেন আমাদের গ্রামের এলাকার এক ধনী জামিদার পরিবারের মেয়ে। তাদের আত্মীয়, সিলেটে চা-বাগানের মালিক নির্মল চৌধুরী যিনি, ঢাকায় আটকা পড়েছিলেন। ঢাকায় তার মতো একজন হিন্দু ধনী ব্যক্তির জন্য থাকা তখন খুব বিপজ্জনক ছিল। তিনি যখন আমাদের মামার কাছ থেকে শুনলেন যে আমরা ৭-৮ পরিবারের একটা দল নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি, তখন নির্মল চৌধুরী একদিন মামার সাথে আমাদের বাড়ীতে এলেন দেখতে যে তিনি আমাদের সাথে যেতে পারেন কিনা। তিনি আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আসলে আমাদের কোনও বাস্তব পরিকল্পনাই ছিল না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে বা যানবাহন যেখানে যা পাওয়া যায় তা ব্যবহার করে চলে যাওয়া। বাসাবো থেকে তারাবো, নদী পার হয়ে নরসিংদী থেকে ভৈরব হয়ে বালাগঞ্জ পৌঁছে সেখান থেকে যার যার গন্তব্যে যাওয়া। এতে প্রায় ৮-৯ দিন সময় লাগবে। পথে ডাকাতের হাতে পড়তে পারি, পাক আর্মির হাতে মারাও পড়তে পারি। খাবার বা ব্যক্তিগত চাহিদা মেটানোর কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। নির্মল চৌধুরী আমাদের এ অবাস্তব পরিকল্পনা শুনে ভীত হয়ে পড়েছিলেন, তিনি যা শুনছিলেন তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি ভাবলেন এর চেয়ে বরং ঢাকায় থাকাই নিরাপদ। তিনি মারাত্মক ভুল করেছিলেন, তিনি যদি আমাদের সাথে যেতেন তবে বেঁচে যেতেন কারণ কিছুদিন পর তাকে ঢাকায় পেয়ে পাকবাহিনী তাকে হত্যা করেছিল।
এপ্রিলের শুরুতে এক সকালে, আমরা আমাদের দীর্ঘ যাত্রা শুরু করি এবং ঢাকা ছেড়ে পলায়নরত লোকজনের কাফেলায় যোগ দেই। আমাদের দলে প্রায় ৭-৮ টি পরিবার ছিল – বাচ্চাকাচ্চা সহ প্রায় ২৫ জন। তখন কেবলমাত্র মূল ঢাকা শহর পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, দেশের বাকি অংশ তখনও মুক্ত ছিল। বাসাবোতে তখনও পাকসেনা আসে নাই। আমরা যাওয়ার আগে কোনও পাকসেনা দেখতে পাই নাই। তবে আমরা জানতাম যে তারা শীঘ্রই আসবে এবং আমাদের পক্ষে ঢাকার বাইরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে যাবে।
আমাদের বাবা এরকম পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ভবিষ্যতের কঠিন দিনগুলি অনুমান করে তিনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখেন নি। এখন সমস্ত ব্যাংক বন্ধ এবং আবার কখন খুলবে তা কেউ জানে না। তবে আমাদের এক ভগ্নিপতি দূরদর্শী মানুষ ছিলেন, তিনি এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী, আমার ফূপাতো বোন আমার বাবাকে চিন্তিত দেখে ফিসফিস করে বললেন "চিন্তা করবেন না মামা, আমাদের সাথে ২০,০০০ টাকা আছে" - সেই সময়ের জন্য তা অনেক টাকা! আমার সে বোন সেদিন আমাদের বাবাকে যা বলে আশ্বস্ত করেছিলেন, তা কোনোদিন ভোলার নয়।
বাসাবো থেকে আমরা রিকশা নিয়ে কিছুদূর গেলাম। কয়েক মাইল পরে রাস্তা শেষ হয়ে গেল, রিকশা আর যাবেনা। সুতরাং, আমরা সবাই তারাবো ঘাটে যাবার জন্য গ্রামের পথে হাঁটা শুরু করলাম। ঘাটে পৌঁছে আমরা ছোট ফেরি নৌকায় করে নদী পার হলাম।
আমরা যেমন সন্দেহ করেছিলাম, পাক সেনারা আমাদের পিছনে পিছনে আসছিল। তারাবোতে যেখানে আমরা নদী পারাপার করেছি, পরের দিন পাকবাহিনী সেখানেই নদী পারাপারকারী বহু লোককে গুলি করে হত্যা করেছিল। তারা মানুষের ঢাকা থেকে পালানো বন্ধ করতে এবং বিশ্বের কাছে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে মরিয়া ছিল। আমরা যদি আর মাত্র একদিন দেরি করে আসতাম তবে নদীতে আমাদের লাশ ভেসে যেতো।
অন্ধকার হবার আগেই আমরা নরসিংদী পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, তাই আমরা না থেমে হাঁটতে থাকলাম। আমাদের সাথে কিছু ছোট বাচ্চা ছিল যারা হাঁটতে পারত না, তাদেরকে কোলে পিঠে করে বহন করতে হয়েছিল। আমাদের কেবলমাত্র একদিনের খাবার সাথে ছিল।
সোনার দেশের- সোনার মানুষ
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেই মানুষের সবচেয়ে ভালো আর সবচেয়ে খারাপ দিক ফুটে উঠে। সেই যাত্রায় আমরা এমন একটা বাংলাদেশ দেখেছি যা হারিয়ে গেছে, আর কেউ কোনোদিন তা দেখতে পাবে না। আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে লোকেরা আমাদের সহায়তা করতে এগিয়ে এলো, তারা শিশুদের ও আমাদের জিনিসপত্র বহন করতে সাহায্য করলো এবং তারা আমাদেরকে খাবার ও পানি সরবরাহ করেছিল। তারা নিজেরাই গ্রামের গরীব মানুষ; এত লোককে খাওয়ানোর সাধ্য তাদের ছিলোনা তবুও তারা যথাসাধ্য করেছে। সবাই গুড়-মুড়ি, মোয়া, বাতাশা, কলা, ডাব - যার ঘরে যা কিছু ছিল তা নিয়ে এসেছিল। মিষ্টি বা হাল্কা নাশতা জাতীয় খাবার কেনার জন্য আমরা পথে ছোট্ট ছোট্ট দোকানগুলিতে যেতাম কিন্তু দোকানদাররা টাকা নিতে চাইতনা। দেশবাসীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের অনুভূতি ছিল এমনই। সবাই ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকদের সাহায্য করতে চাইছিল।
আমরা বিকেলে নরসিংদী পৌঁছি। আমাদের বড়রা ভৈরবে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা বড় মহাজনি নৌকা সন্ধান করছিলেন। ভৈরব যাবার নদীপথ ডাকাতের জন্য কুখ্যাত, রাতে নিরাপদ নয় বলে স্থানীয় লোকজন আমাদের নরসিংদীতে রাত কাটাতে পরামর্শ দিয়েছিল। তবে আমরা মরিয়া ছিলাম; অন্তত একটা নৌকা আমাদের জন্য আশ্রয় হবে যেখানে আমরা বিশ্রাম নিতে পারবো, এবং নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে ছিল না, আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। আমাদের বড়রা একটা বিশাল নৌকা ভাড়া করলেন। সেটা এতো বড় ছিল যেখানে একজন পূর্ণ মাপের লোক ভিতরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো। নৌকার মাঝিমাল্লা ছিল ৫-৬ জন। আমরা সবাই ক্লান্ত ছিলাম। মহিলারা এবং শিশুরা ভিতরে এবং পুরুষ এবং ছেলেরা ছৈ এর উপরে বসে পড়লাম।
যখন নৌকা তীর থেকে প্রায় মাঝ নদীতে চলতে শুরু করলো, সূর্য তখন নদীর উপর অস্ত যাচ্ছিল। দূরে গ্রামের মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছিল।
এমন সময় নদীর তীর থেকে একজন লোকের চীৎকার শোনা গেল, “ভাইরা, দয়া করে আমাকে আপনাদের সাথে নেন, আমিও সিলেট যাবো। আপনারা আমাকে না নিলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, দয়া করে আমাকে বাঁচান”। আমরা সবাই তার দিকে তাকালাম, প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছিল এবং সে আলোয় তাকে দূর থেকে এঞ্জন রাজনৈতিক নেতার মতো লাগছিল! সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, মুজিব কোট, গোঁফ, ব্যাক ব্রাশ করা চুল। আহাম্মক লোকটা নিজেকে পাক আর্মির টার্গেট করে ঘুরছে। স্পষ্টতই সে জানে যে আমরা সিলেট যাচ্ছি, ঘাটের কেউ নিশ্চয় বলেছে। অন্য সময়ে আমরা অজানা জায়গায় কোনও অচেনা লোকের ডাকে সাড়া দিতাম না, কিন্তু তখন একটা জটিল সময় ছিল, আমরা এই হতভাগা লোকটির আবেদন উপেক্ষা করতে পারি নাই। আমাদের বড়রা তাকে তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। লোকটি যখন নৌকায় উঠলো, আমরা তাকে জানতে চাইলাম। সে দাবি করলো যে সে এলিফ্যান্ট রোড এলাকার একজন নেতা, “সে বললো, “এলিফ্যান্ট রোডের প্রতিটি তিনজনের মধ্যে একজন আমাকে চিনে”।
রাত হয়ে এলে মাঝিরা নৌকাটি পাড় থেকে দূরে মেঘনা নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে। আমরা দেখলাম একে একে আরও অনেক বড় বড় নৌকা এসে আমাদের চারপাশে লাগালাগি করে নোঙ্গর করছে। আমরা খুব ভয় পেয়ে গেলাম। কারো উপর বিশ্বাস রাখার উপায় ছিলোনা, মাঝিরা নিজেরাই হতে পারে ‘ডাকাত’। তারা জানে যে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা প্রত্যেকের কাছে প্রচুর নগদ ও গহনা থাকবে। দেশে তখন আইন শৃঙ্খলা বলে কোনকিছু বা কোনও সরকার ছিল না। মাঝিরা বুঝতে পারলো আমরা ভয় পাচ্ছি, তারা আমাদের আশ্বস্ত করে বললো যে অন্যান্য নৌকাগুলো আমাদের সুরক্ষার জন্য এসেছে। রাতে মেঘনা নদীর মাঝখানে পারস্পরিক সুরক্ষার জন্য এটি একটা প্রচলিত রীতি। আমরা সকলেই ক্লান্ত ছিলাম এবং শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লাম।
দুর থেকে ভেসে আসা ফজর আজানের শব্দে আমরা জেগে উঠলাম। দেখলাম আমরা বেঁচে আছি, কিছুই ঘটেনি, সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের বিশ্বাস তারা ভঙ্গ করে নাই। মাঝিরা সকালের নামাজের জন্য এবং আবার রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নৌকা থেকে মেঘনায় সূর্যোদয়, কুয়াশাতে, চারদিক নীরব, কোন শব্দ নেই, শুধু ঢেউয়ের ‘ছলাত ছলাত’ শব্দ, অবিস্মরণীয়!
আমাদের বজরা আবার যাত্রা শুরু করল, বজরাটি খুব ধীরে চলছিল কারণ আমরা স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছিলাম। পরের কয়েক দিন আমরা বজরার ছাদে আমাদের দিনগুলি কাটাতাম নদী ও দুই পাড়ের চলমান জীবনযাত্রা দেখে দেখে। মাঝেমধ্যে আমরা মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখি। তারা বাঙালী বা অবাঙালি হতে পারে তবে তারা মানুষ ছিল, তাদের প্রিয়জনরা তাদের মৃত বা জীবিত সন্ধান করবে কিন্তু কোনদিনই তারা তাদের খুঁজে পাবে না।
আমাদের দলে একজন পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন, তিনি আমাদের এক দূর সম্পর্কের মামা। তিনি বলেন যে তিনি রাজারবাগ থেকে পালিয়ে এসেছেন। মামা আমাদের তার লড়াইয়ের বীরত্বপূর্ণ গল্প শুনাতেন। তিনি একজন সবজান্তা মানুষ ছিলেন। তার শিক্ষাদীক্ষা বেশী ছিলোনা, কিন্তু তিনি আমাদের ছোটদেরকে নাবালক নালায়েক মনে করতেন যারা কিছুই জানেনা, কিছুই শিখেনাই - সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তিনি আমাদের জ্ঞানদান করার কোন সুযোগ হারাতেন না। আমরা তাকে নিয়ে বেশ মজা করতাম এবং মূর্খের ভান করতাম যাতে মামা আমাদের জ্ঞানদান চালিয়ে যেতে পারেন, এতে মামার উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি আমাদের জন্য বিনোদনের এক উৎস ছিলেন! এছাড়া ছিলেন সেই ‘আওয়ামী নেতা’। তিনি সব নেতাদের চেনেন, সবার সাথে তার উঠাবসা এবং রাজনীতির এমন কিছু নাই যা তিনি জানতেন না, এমনভাবে কথা বলতেন যেন মুজিব প্রতিদিন তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন – তিনিও আমাদের বিনোদনের আরও এক উৎস। মামা আর নেতার মধ্যে প্রায়ই মতবিরোধ লেগে যেতো কারণ দুজনেই ছিলেন সবজান্তা, যা ছিল আরও মজার।
মাঝে মাঝে আমরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য নদীর তীরে বাজারে থামতাম। সর্বত্র একই অবস্থা, তারা টাকা নিতে চাইতনা। একজন ‘মিষ্টি’ বিক্রেতা বিনামূল্যে আমাদের কিছু রসোগোল্লা দিয়ে দেন। মাছ সব্জি যা যেখানে পাওয়া যেতো তাই মাঝিরা রান্না করতো সবাই তাই খেতাম। নদীর মাঝখানে সে সাধারণ খাবার, মাছভাজা, শাক, ডাল যেন অমৃত।
প্রায় ৩ দিন পর আমরা ভৈরবের পুল দেখতে পেলাম, অনেক দূরে আবছা ভাবে। আমরা দেখে খুব আনন্দিত হলাম; এটি জাহাজে আমেরিকা যাত্রাকারী ইউরোপীয় রেফিউজীদের প্রথম স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখার অনুভূতির মতো ছিল। তবে আমরা জানতাম না যে সেখানে পৌঁছাতে আমাদের আরও ২-৩ দিন লাগবে। আমরা যতই এগুতে থাকি পুলটি মরীচিকার মতো আরও দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হতো।
আরও ৩ দিন পর আমরা অবশেষে ভৈরব পৌঁছি। আমাদের বজরাটি সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা অবাক হয়ে সেতুর দিকে চেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমরা অন্তত একটা লক্ষ্য অর্জন করেছি। আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলাম। ‘নেতা’ এখানে আমাদের ছেড়ে চুলে গেলেন। আমাদের বড়রা আমাদের যাত্রার পরবর্তী পরিকল্পনা করতে এবং যানবাহনের কিছু একটা উপায় খুঁজতে গেলেন।
তারা সুসংবাদ নিয়ে ফিরে এলেন। ভৈরব থেকে বালাগঞ্জের মোটর-লঞ্চ সার্ভিস তখনও চলছিল। আমরা একদিনে বালাগঞ্জ পৌঁছানোর জন্য একটা ছোট লঞ্চে উঠলাম। বালাগঞ্জে আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজন থাকতেন। বালাগঞ্জের ঘাটে পৌঁছানোর পর বাজারের লোকজন ভীড় করে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকদের দেখতে এলো। ততদিনে ঢাকার খবর সবখানে পোঁছে গেছে। তবুও লোকজন আমাদের মুখে শুনতে চাইতো। নদীর পাড়ে ছোট বসতি সবাই সবাইকে চেনে। আমাদের আত্মীয়দের নাম বলতেই কেউ না কেউ গিয়ে তাদের খবর দিলো। সবাই দৌড়ে এলো। এই অজপাড়াগাঁয়ে ঢাকা থেকে এতোগুলো আত্মীয় তদের বাড়ী আসবে এটাতো অকল্পনীয়। তারা আমাদের খুব আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন। মোরগ – খাসি জবাই করে বিয়ে বাড়ীর মতো মহা উৎসব শুরু করে দিলেন। দীর্ঘ ৬-৭ দিন পর আমরা মোরগ মাংস সহ মাছ ভাত পেট ভরে খেলাম।
বালাগঞ্জ কুশিয়ারা নদীর তীরে একটা ছোট বাজার ছিল। লোকজন ঢাকায় পাকবাহিনীর অভিযানের কথা শুনেছিল তবে তাদের কী করা উচিত তা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। তবে সাধারণ মানুষ যা কিছু ছিল তাই নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিল, তারা বর্শা, রামদা, কুচা, জাঠা যার যা আছে তাই নিয়ে আধুনিক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সজ্জিত পাক আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
পরের দিন আমাদের আত্মীয়রা আমাদের কুশিয়ারা নদীর তীরে ছোট্ট একটা গ্রাম বাদেপাশায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটা ছোট নৌকা ভাড়া করলেন। সেখানে আমাদের এক কুটুমবাড়ী ছিলো। আমার চাচাতো বোনের শ্বশুরবাড়ী। ওরা সেখানে খুব প্রতাপশালী ছিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা সেখানে পৌঁছি। আমরা ঘাটে নৌকা লাগাতেই বাজার থেকে অনেক লোক আমাদের আত্মীয়দের দেখতে এলো। তার থেকে একজনকে আমাদের আত্মীয়দের খবর দেয়ার জন্য পাঠানো হল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের আত্মীয়রা অনেক লোকজন নিয়ে আমাদের নিতে এলেন এবং আমাদের জিনিসপত্র এবং ছোট শিশুদের ধরাধরি করে তুলে নিলেন। তারাও খুব খুশি কারণ ঢাকা থেকে আসা একসঙ্গে এত বেশি অতিথি সাধারণ পরিস্থিতিতে এমন প্রত্যন্ত গ্রামে পাওয়ার কথা নয়। তারা আমাদের জন্য রীতিমতো একটা ভোজের আয়োজন করলেন, পোলাও, কোরমা, রেজালা, কাবাব ইত্যাদি সহ, যাইহোক আমরা তো তাদের ছেলের শ্বশুরবাড়ীর লোক!
পরের দিন তারা আমাদেরকে আমাদের গন্তব্য, কুশিয়ারা নদী থেকে কেটে নেয়া 'কুড়াগাং' নামের একটা ছোট নদীর পাশে আমাদের গ্রাম রায়গড় নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও কয়েকটি ছোট নৌকা জোগাড় করে দিলেন। নদীর নাম থেকেই বোঝা যায় যে এটি আসলে আমাদের পূর্বপুরুষের কৃষিজমিগুলির মধ্য দিয়ে একটা সেচের জন্য খনন করা একটা খাল। (সিলেটীতে কুড়া মানে খনন করা)। আমাদের গ্রাম নদী থেকে এক মাইল দূরে। এটা একটা খুব আরামদায়ক ভ্রমণ ছিল। নিস্তরঙ্গ নদীতে মাঝিরা কখনও বইঠা আবার কখনও লগি ব্যবহার করছিলো বা গুণ টানছিল। নদীর পাড় ধরে আশেপাশের গ্রামের উৎসুক ছেলেমেয়ারা আমাদের নৌকার সাথে সাথেই হেটে যাচ্ছিল। নদীর পারে কোথাও ছোট বাজার, কোথাও খেয়া ঘাট, কোথাও বটগাছের নিচে লোকজন গল্পগুজব করছে, শান্তিতে হুকা টানছে। কারো কোন ধারনাই নাই আগামী কয়েক মাসে তাদের সবার জীবন ওলটপালট হয়ে যাবে। কেউ হয়তো বেঁচেও থাকবেনা।
বিকেলের দিকে আমরা আমাদের গ্রামের পেছনের কুড়াগাং এ পৌঁছে গেলাম। আমরা জীবিত অবস্থায় আমাদের বাড়ী পৌঁছতে পেরে খুব উচ্ছ্বসিত এবং স্বস্তি পেয়েছিলাম; নৌকা থেকে নেমে ‘বাড়ী’ যাওয়ার জন্য আমাদের আর তর সইছিলনা। গ্রামের লোকদের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। যেকোনভাবেই আমাদের আসার খবর বাড়ী পৌঁছে গেল এবং আমাদের ভাইবোনরা, চাচা চাচীরা, কাজের লোকজন নিয়ে আমাদের বাড়ী নেবার জন্য এগিয়ে এলেন। বাড়ী পৌঁছেই আর দেরী না করে বহুদিন পর আমরা পুকুরে ঝাপিয়ে পড়লাম - আমরা মুক্তস্বাধীন বন্ধনহীন!
আমাদের গ্রাম - রায়গড়:
এপ্রিল-আগস্ট ১৯৭১
প্রায় ৬০০ বৎসর আগে মোঘলদের কাছে পাঠানদের পরাজয়ের পর পাঠানরা সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাদের একজন, আমাদের পূর্বপুরুষ রায়গড়ে তিনটি টিলা নিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এখন ৩টি টিলা নিয়ে সে বাড়ী চার শরিকে বিভক্ত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় সবগুলো বাড়ী মিলে একটা বড় বাড়ী হয়ে গিয়েছিল যেখানে অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছিল এবং আত্মীয় পরিচয়ে আরও লোকজন ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে থাকলো যাদেরকে আমরা আগে কোনোদিন দেখিনি। ভুতের মতো অচেনা লোকজন অন্ধকার থেকে উদয় হত যাদের মধ্যে অনেক রহস্যময় ও জঙ্গি ভাবাপন্ন লোক ছিল, এর মধ্যে একজনের ছদ্দনাম ছিল ‘কাউয়া লতিফ’ আরেকজন ‘জঙ্গি মাশুক’ এরা খুব জঙ্গীভাবাপন্ন ছিলো। লতিফ গ্রামের ছেলেদের লেফট-রাইট করাতো। আর জঙ্গি মাশুকের কাজ ছিলো ভীতিকর গুজব ছড়ানো।
রায়গড়
একটা খুব পাহাড়ি গ্রাম।
সম্ভবত এই কারণেই আমাদের পাঠান
পূর্বপুরুষরা বসতি স্থাপনের জন্য অঞ্চলটি বেছে
নিয়েছিলেন। প্রতিটি বাড়ী একেকটি
টিলার উপরে তৈরি, প্রতিটি টিলার তিনটি স্তর। টিলার নীচে পুকুর বা দিঘি, এক সিঁড়ি উপরে একটা স্তর, যেখানে একটা "টঙ্গি" (কাছারি ঘর) থাকে তারপরে আরেক প্রস্থ সিঁড়ির ওপরে আরেকটি স্তর যেখানে মূল বাড়ী। বসতি স্থাপনকারীরা পাহাড়ের চূড়া
সমতল করার সময় পর্দার জন্য চার পাশের মাটি না কেটে মাঝখানটা ৩-৪
ফুট গভীর করে কেটে সমতল করে সেখানে বাড়ী বানাতেন। বাড়ীর চারপাশের এ স্বাভাবিক মাটির দেয়ালকে বলা হত ‘দিওয়ার’
(সম্ভবত পশতু শব্দ)। টিলাগুলোর মাঝখানে সরু ও আঁকাবাঁকা পাহাড়ী হাটাপথ। ঘন গাছপালার
কারণে সেই পথগুলোর কিছু অংশ, স্থানীয়ভাবে ‘হান্দি’ (খুব সম্ভব আন্ধি থেকে এসেছে) নামে
পরিচিত, যা দিনের বেলাও অন্ধকার থাকতো। গ্রামটি ঢাকাদক্ষিন বাজার এবং মূল সড়কের সাথে প্রায় ২ মাইল দীর্ঘ সরু আঁকাবাঁকা মাটির রাস্তায় সংযুক্ত
ছিল যা ভারী সেনা-যানবাহনের জন্য উপযুক্ত ছিলোনা। গ্রামটি ঘনবসতিপূর্ণ ছিলনা কারণ
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ছিল হিন্দু
যারা ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর ভারতে
পাড়ি জমায়।
এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত আমরা মূলত রায়গড়ে থাকি। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় আমাদের জন্য তা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। সে সময় ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে অবিস্মরণীয় সময়। পাক আর্মি কখনই রায়গড়ে আসেনি। আমি ঠিক জানি না কেন তবে আমি যদি আমাদের গ্রামের ভৌগলিক চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেই তবে তার কারণ হয়তো কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।
কোনও সেনাবাহিনী বিনাকারণে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেয় না এবং রায়গড় সম্ভবত তাদের জন্য সামরিকভাবে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এবং তা তাদের জন্য কোনও গুরুতর হুমকিও তৈরি করে নি। তাই, তারা যখন এসেছিল, তারা আমাদের গ্রামকে পাশ কাটিয়ে মূল রাস্তা দিয়ে চলে গেছে। সুতরাং, গ্রামে আমরা বেশ নিরাপদ বোধ করতাম। আমাদের ঘরগুলি তিনটি সংযুক্ত টিলায় ছড়িয়ে ছিল। আমাদের ‘টঙ্গি’ ছিল একটা বিশাল বড় ঘর। সেখানে বাড়ীর বাচ্চাদের জন্য একজন মাস্টার এবং একজন মৌলভী থাকতেন। হঠাৎ আসা অতিথিদের জন্য সেখানে গণ-বিছানা ফেলা হয়েছিলো। সেখানে ১০-১২ জন লোক ঘুমাতেন যারা বাড়ীর মালিকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত নন। আমরা আমাদের সারাদিন "টঙ্গি" তে দাবা, দশ-পচিশ, তাস, লুডু এবং ক্যারাম ইত্যাদি খেলে কাটাতাম।
শেষ বিকেলে আমরা সবাই দলবেঁধে বাজারে যেতাম। আমাদের চাচাদের সেখানে ব্যবসা ছিল। আমার বাবা এবং তার কাজিনরা তাদের শৈশবের বন্ধুদের সাথে দেখা করতেন। আমরাও সাথে যেতাম। আমার চাচা বাজারের কাছে একটা বড় পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ী কিনেছিলেন; আমরা সেখানে গিয়ে পুকুরে মাছ ধরতাম। সেখানে একটা চায়ের স্টল ছিল, আমাদের প্রিয়, বলা হত ‘চেরাগের টী-স্টল’; সে দোকানের চা অসম্ভব মজার ছিল। এছাড়া এটি ছিল সমস্ত রাজনৈতিক সংবাদ এবং গুজবের কেন্দ্র।
আমরা আমাদের চাচার ফার্মাসিতে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। তিনি একজন ফার্মাসিস্ট ছিলেন, তবে বাজার ও আশেপাশের গ্রামের জন্য তিনি ছিলেন বেশ ভালো এবং খুব জনপ্রিয় ‘ডাক্তার’। ওষুধ তৈরির জন্য তাঁর পিছনের ঘরে নানা ধরণের সিরাপ ছিল। আমরা তা সব সাবাড় করে দিতাম! চাচা জানতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। সামনের ঘরে তিনি তার বন্ধুদের সাথে একটা দরবার বসাতেন। আমরা তাদের রাজনৈতিক আড্ডা উপভোগ করতাম। তবে সবাইকে পাকিস্তান বা পাক আর্মির বিরুদ্ধে কিছু না বলার জন্য সতর্ক থাকতে হত। চাচা কিছুই বলতেন না শুধু চোখ বুজে সিগারেটে দম দিয়ে শুনে যেতেন।
একদিন একটা আর্মি জিপ এসে আমার চাচার ফার্মাসির সামনে থামল। সবাই বেশ ভীত হয়ে গেল। তারা রাস্তার লোকজনকে বাজারের পাশের কোনও একটা বাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য একজন লোক দেবার জন্য বললো। আমার চাচার ফার্মাসিতে বসে থাকা দু'জন লোক এটা শুনে এক লাফে গিয়ে জিপে উঠলো এবং তাদের নিয়ে জিপটি চলে গেল। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের আশেপাশের সাধারণ মানুষেরা এভাবেই দালাল বা সহযোগী হয়ে ওঠে। কারও উপর বিশ্বাস রাখা যেতো না। এটাই গৃহযুদ্ধের প্রকৃতি, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, আপনার শত্রু হয়তো আপনার ্পাশেই বসে আছে বা আপনার বাড়ীতেই থাকে। ভাগ্যক্রমে, পরে আমরা শুনলাম যে ওই বাড়ীর কারও বিপদ হয় নাই। তবে এ ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে শত্রু কত কাছে, একটা ভুল কথা কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
আমাদের গ্রাম থেকে মাইল খানেক দুরে ঢাকাদক্ষিন বাজার। একসময় এটা আঞ্চলিক বানিজ্যের কেন্দ্র ছিলো। প্রায় সব ব্যবসায়ীরা হিন্দু ছিল তাই হিন্দুরা ভারতে চলে যাওয়ায় এর বানিজ্যিক গুরুত্ব কমে যায়। এছাড়াও এর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছিলো। বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী চৈতন্যদেবের পৈত্রিক বাড়ী ও মন্দির বাজারের পাশেই। নিমগাছের নীচে জন্ম হয়েছিলো বলে তার ডাকনাম রাখা হয় নিমাই। এছাড়া তিনি চৈতন্য মহাপ্রভু নামেও পরিচিত। তার আসল নাম ছিলো বিশ্বম্বর মিশ্র, বাবার নাম ছিলো জগন্নাথ মিশ্র। বাজারের পাশের ঐ এলাকাটার নাম মিশ্রপাড়া। ওখানে এখনও কিছু মিশ্র পরিবার থাকেন। তার পৈত্রিক বাড়ী স্থানিয়ভাবে দাদাইবাড়ী বা মহাপ্রভুর বাড়ী নামে পরিচিত। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের আগে পর্যন্ত প্রতি বৎসর চৈত্র মাসে হাজার হাজার হিন্দু তীর্থযাত্রীরা ভারত থেকে আসতেন। ঐ সময় ওখানে বিশাল মেলা বসতো। আমার ছোটবেলার সেটা এক মধুর স্মৃতি। সিলেট থেকে ঢাকাদক্ষিন যাবার রাস্তাটা মোঘলরা তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে নির্মাণ করে।
ঢাকাদক্ষিনে প্রতিদিন বাজার বসতো তবে সপ্তাহের বিশেষ একদিন বড় বাজার বসতো যাকে বলা হয় বাজার দিন। বাজারে আমরা প্রায়ই যেতাম তবে বাজার দিনে আমাদের বাজারে যাওয়া খুব বড় ব্যাপার ছিল। আমরা বাড়ীর মাস্টার-মৌলভী সহ আমাদের বড়দের সাথে একসাথে দল বেঁধে যেতাম। আমাদের বাড়ীর কামলারাও সিকা-বাং নিয়ে আমাদের সাথে যেতো। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। পুরো বাজার অসংখ্য কেরোসিনের ল্যাম্প বা কুপি দিয়ে আলোকিত থাকতো। সে এক মায়াবী পরিবেশ। দোকানীর মুখ কুপির আলোয় জ্বলজ্বল করতো। কুপির আলোয় কেবল তার চারপাশের জিনিসগুলিই দেখা যেতো। এর বাইরের সবকিছু ছিল এক আলো-আঁধারির খেলা। আমরা কোন কোন সময় বাজারের মসজিদে নামাজে যোগ দিতাম।
আমাদের বাড়ী ফেরাও ছিল আরেক পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা। যেহেতু বিদ্যুৎ ছিল না; কেউ কেউ হারিকেনের লণ্ঠন বা টর্চলাইট রাখত। তখন যাদের হাতে টর্চলাইট থাকতো তাদের ওটা নিয়ে বেশ ভাব থাকতো। পরে বাজার থেকে ব্যাটারী উধাও হয়ে গেলে হারিকেনই ছিলো একমাত্র ভরসা। কিছুদিন পর কেরোসিন তেলের দাম বেড়ে গেলো এমনকি দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেলে সাশ্রয়ের জন্য চাঁদের আলোয় বা অন্ধকারেই চলাচল করতে হতো।
চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে অনেক কিছুই দেখা যায়। চাঁদনী রাতের অভিজ্ঞতা অন্যরকম ছিল। কখনও চাঁদনী রাতে গ্রামের রাস্তায় না হেঁটে থাকলে এটা বুঝা যাবেনা। যখন আমরা বাড়ী ফিরতাম তখন বিপরীত দিক থেকেও লোকজন আসতো। প্রায় সকলেই বাজার ফেরতদের হাতে লটকানো মাছের দাম জিজ্ঞাসা করতো, এটা গ্রামের একটা রীতি। গ্রামের সরু রাস্তায় প্রায়শই, আমাদের অন্যকে যেতে দিতে রাস্তা থেকে নেমে যেতে হতো। আমাদের একজন ভাই "বাঁশ বাঁশ" বলে চিৎকার করত যার অর্থ আমরা কাঁধে বাঁশ নিয়ে আসছি, অন্য দিকের লোকেরা এটা শুনে বাঁশের ডগার বাড়ি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য রাস্তা থেকে নেমে আমাদের যেতে দিত, যখন বুঝতো আমাদের সাথে কোন বাঁশই ছিল না ততক্ষণে আমরা অন্ধকারে অনেক দূর এগিয়ে গেছি!
পথে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানটি পার হতে হতো। সেখানে ছিল বড় বড় বটগাছ সহ একটা ভীতিকর জঙ্গল। আমাদের কেউ তখন একটা ভূতের গল্প শুরু করতোই, বিশ্বাসযোগ্য ভূতের মুখোমুখি হবার গল্প, একা রাতে হাঁটার সময় পেছনে পায়ের শব্দ, অথচ কেউ পিছনে নেই বা সামনেই একটা সাদা কুকুর মাটির অনেক উপর দিয়ে হাঁটছে, তার পা মাটিতে নেই বা গাছ থেকে কেউ ঝুলছে এসব। যখন কবরস্থান থেকে গাছের ডালপালা একে অপরে সাথে ঘষা লেগে নানা ভৌতিক শব্দ করছে এবং বটগাছগুলি থেকে মাথায় বটফল বা বিচি পড়ছে যেন ভুত ঢিল মারছে, তখন এসব গল্প বিশ্বাস না করে উপায় ছিলোনা! যারা ভুতে বিশ্বাস করতো না তারাও সে পথে একা যেতে সাহস করতো না।
অন্ধকার রাতে গ্রামটি খুব সুন্দর লাগতো। একমাত্র আলো ছিল বাড়ীর ভেতরের তেলের বাতিগুলির কমলা রঙের আলো, পাহাড়ের উপরে ঘরগুলির জানালা দিয়ে সে আলো উপচে পড়তো – আর বাইরে ছিল জোনাকীর ঝিকিমিকি আলো, হাজার হাজার জোনাকি।
পরের কয়েক সপ্তাহে আরও অনেক লোক আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে এলো, আত্মীয় ও অনাত্মীয়। সারা বাড়ী ভর্তি মানুষ। এর মধ্যে কিছু খুব মজার লোক ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি একজন অবাঙালী হত্যা করেছেন বলে শুনেছি। তাকে আমরা দুলাভাই ডাকতাম। কিভাবে দুলাভাই তা জানিনা। তিনি সবসময় খুব আতঙ্কিত থাকতেন, এমনকি যখন তিনি ঘুমিয়ে থাকতেন, তখনও যদি কেউ ‘পাঞ্জাবি’ বা ‘আর্মি’ শব্দটি বলতো, সাথে সাথে তিনি লাফিয়ে উঠতেন। আর আমরা এটা প্রায়ই করতাম।
এ ছাড়া গণহত্যা থেকে বেঁচে পালিয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন ছাত্র ছিলেন। আমাদের টঙ্গির মৌলভী ছিলেন একজন মজার লোক। আমাদের উত্তপ্ত বিতর্কে তিনি শান্ত এবং নিরপেক্ষ থাকতেন। মৌলভী ছিলেন সিলেট শহরের সাথে আমাদের যোগাযোগ। তার জন্য ১২ মাইল দূরে সিলেট শহরে যাওয়া অনেক নিরাপদ ছিল এবং তিনি মাঝে মাঝে যেতেন। তিনি শহরের পরিস্থিতির খবরাখবর নিয়ে ফিরে আসতেন। আর ছিলেন এক মাস্টার, সবজান্তা ধরণের, সবসময় তিনি আমাদেরকে বোকা বানাবার চেষ্টা করতেন, আমাদের কয়েকজনের সাথে প্রায়ই তাঁর টক্কর লাগতো এবং তারাও তাকে ছাড় দিত না।
গ্রামের অন্য বাড়ীগুলিতেও অনেক লোক আশ্রয় নেন যারা সামাজিকতার জন্য আমাদের টঙ্গিতে আসতেন। তার মধ্যে একজনকে তাঁর খুব কালো চেহারার জন্য ‘কাউয়া লতিফ’ ডাকা হত। তিনি একজন ‘আনসার’ কমান্ডার ছিলেন তাই তিনি মনে করেছিলেন যে গ্রামের ছেলেদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া তাঁর দায়িত্ব। কয়েকদিন ছোট ছোট ছেলেদের লাইন ধরিয়ে তিনি লেফট-রাইট করালেন। তবে তিনি বেশীদিন তাদের আগ্রহ ধরে রাখতে পারেন নি, তাই তিনি যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে যান। পরে আমরা জানতে পারি তিনি যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
প্রতি রাতে আমাদের টঙ্গিতে একটা আসর বসতো। কেবল একটা হারিকেন মিট মিট করে জ্বলতো। তাতে আলোছায়ার এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি হতো। পুরো বাড়ীর এমনকি আশেপাশের বাড়ীর সব পুরুষ এবং ছেলেরা একসাথে বসে, স্বাধীন বাংলা বেতার, রেডিও পাকিস্তান, আকাশবাণী, বিবিসি এবং ভয়েস অফ আমেরিকার সংবাদ অনুষ্ঠান শোনা হতো। তখন টু শব্দ করাও নিষেধ ছিলো, করলেই মুরব্বীরা ক্ষেপে যেতেন। সব সংবাদ শেষ হওয়ার পর সেখানে চলমান বিষয়, গুজব, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলতো। সাথে চলতো বাড়ীর ভেতর থেকে আসা চা, নাশতা এবং পান-তামাকের অন্তহীন সরবরাহ। মাঝেমধ্যে আমরা খুব কাছাকাছি কামানের বা মর্টারের ‘ভুম’ শব্দ শুনতে পেতাম। আমাদের মধ্যে কিছু দুষ্ট ছেলেরা সহজে ঘাবড়ে যাওয়া লোকদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য কৃত্রিম ‘ভুম’ শব্দ তৈরি করতে বড় বড় কাঠের খুটিতে হাল্কা লাথি মারতো, উপরে টিনের ছাদ থাকায় তা অবিকল সে রকম শব্দ করতো। এতে অনেকেই কান খাড়া করে সটান হয়ে যেতেন।
আমাদের একজন মুরব্বী ছিলেন যিনি পুরানো দিনের গল্প করতেন, তিনি আমাদের পারিবারিক ইতিহাস, স্থানীয় ইতিহাস এবং আসামের শিলং, বদরপুর, করিমগঞ্জ, ডিব্রুগড় নিয়ে দেশভাগের আগে তাদের জীবনের অনেক মজার গল্প করতেন আর আমরা কান ভরে শুনতাম। আমরা রাতের এই আসরের অপেক্ষায় থাকতাম।
টঙ্গির বাইরে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে হঠাৎ ভূতের মতো কেউ প্রায়ই খারাপ খবর নিয়ে উদয় হতো, যেমন গ্রামে কিছু অচেনা লোকের সন্দেহজনক চলাচল রয়েছে, বা পাক আর্মিকে এদিকে আসতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন ছিলো জঙ্গি মাশুক, সে আসা মানেই কোন খারাপ খবর আছে, তাঁর কাছে কোন ভালো খবর থাকতো না।
আস্তে আস্তে যুদ্ধের প্রভাব অনুভব হতে লাগলো। দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উধাও হয়ে গেল। চাল,ডাল তেল, চিনি, লবণ, ময়দা এবং ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলি দুর্লভ হয়ে উঠছিল। দাম লাগামছাড়াভাবে বাড়তে লাগলো। ভাত নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার ছিল না, কারণ ভূস্বামী পরিবার হিসাবে, আমাদের পরবর্তী মরসুম পর্যন্ত পর্যাপ্ত ধান মজুত ছিল। চোরাচালান হয়ে ভারতীয় পণ্যগুলি আসতে শুরু করলো, বিশেষত সিগারেট এবং ‘বিড়ি’। সেই প্রথম আমরা গল্পে পড়া কিরিটি রায়ের চারমিনার সিগারেট দেখলাম। বিড়ি সিগারেট তখন মহার্ঘ্য বস্তু। ধূমপানে নেশাগ্রস্থদের একবেলা ভাত না খেলেও চলবে কিন্তু ওগুলো লাগবেই। তাই তারা এসব লুকিয়ে রাখতো এবং অন্যরা চুরি করতো – এ নিয়ে কত ঝগড়া!
একদিন একটা খারাপ খবর বাজারে ছড়িয়ে পড়লো, পাক সেনারা এদিকে আসছে, এবার এটা গুজব নয়। আমরা শুনলাম যে তারা আসার পথে বাড়ীঘর এবং দোকানপাট জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। আমরা দূর থেকে ধোঁয়া দেখতে পেতাম। খবরটি সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলল। প্রতিটি দোকানের লোকজন তাদের জিনিসপত্র অন্যত্র সরাতে শুরু করে। আমার চাচা তার ওষুধ সহ তার পুরো ব্যবসা বাড়ীতে নিয়ে আসেন। গ্রামেও আতঙ্ক দেখা দিল। প্রবীণরা সব মেয়েদের আমাদের প্রত্যন্ত গ্রাম বাদেপাশায় আমাদের আত্মীয়দের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেখানে আমরা আসার পথে উঠেছিলাম। বাড়ীর ছেলেরা রাতের জন্য লুকিয়ে থাকতে পাশের এক পরিত্যাক্ত টিলায় জঙ্গলের ভেতর চলে গেলাম। সাধারণভাবে আমরা বিষাক্ত সাপের ভয়ে সেখানে যাওয়ার সাহস করতাম না।
আমরা শুনতে পেলাম বন্দুকের গুলির শব্দ খুব কাছে এগিয়ে আসছে এবং কাছেই আকাশে ধোঁয়া উঠছে। পাকসেনারা গ্রামে কখন আসব তা ভেবে আমরা প্রতিটি মুহুর্ত গুনছিলাম। তারা বাজারের পাশেই জামিদার কালী প্রসন্ন চৌধুরীর পারিবারিক বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং প্রধান রাস্তা ধরে সিলেটের দিকে যাওয়ার আগে শ্রীচৈতন্যদেবের (বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা) পৈতৃক বাড়ী এবং মন্দিরকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। আমরা কদিন পরে গিয়েও দেখতে পাই জমিদার বাড়ীর বড় বড় খিলানগুলি তখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে।
পাকসেনারা গ্রামে না ঢুকে বড় রাস্তা ধরে সিলেটের দিকে চলে যাওয়ায়, স্বস্তি পেয়ে আমরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম। বনের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। আমরা যখন কিছু পরিচিত ভুতুড়ে এলাকা দিয়ে চলছিলাম তখন আমাদের সাথের একজন ‘মামু’ ‘মামু’ করে ভুতকে ডাকতে শুরু করে। এটি অন্ধকারে ভয় জয় করার একটা উপায়; মামা অবশ্যই ভাগ্নেদের কোন ক্ষতি করবেন না - এই ভরসায়!
তবে এর পর এক সময়ের জমজমাট বাজার প্রাণহীন হয়ে গেলো। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা আবার চালু করতে খুব ভয় পেত। ভাগ্যক্রমে এটি ছিল কাঠালের মরসুম। আমাদের দাদাবাড়ীতে পূর্বপুরুষদের লাগানো অনেক কাঠাল গাছ ছিল। প্রতিটি গাছের কাঠালগুলি আলাদা স্বাদের ছিল এবং আমার মতে সেগুলি ছিল সেরা কাঠাল। আমরা কাঠাল ও মুড়ির সাথে সকালের নাশতা করতাম, কাঠাল বিচির তরকারি দিয়ে দুপুরের ও রাতের খাবার হতো এবং কাঠালের খোসা গরুগুলিকে খাওয়ানো হতো।
কয়েক সপ্তাহ পরে পাক আর্মি রেডিওতে সকল সরকারী কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বললো, নতুবা তাদের বরখাস্ত করার হুমকি দিল। মুক্তিবাহিনী রেল লাইন ও সেতু উড়িয়ে দেওয়ায় ট্রেনগুলি নিয়মিত চলছিলোনা। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পাক সেনারা ইঞ্জিনের সামনে কয়েকটি খালি বগি রেখে ট্রেন চালাতো। সিলেট থেকে ঢাকা পিআইএ-র অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট কঠোর সামরিক নিয়ন্ত্রণে সীমিতভাবে চলছিল - দিনে শুধু একবার। আমার বাবা এবং চাচারা ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের থেকে বিদায় নিলেন, আমরা জানতাম না তাদের সাথে আবার আমাদের কোনোদিন দেখা হবে কিনা।
আমাদের নানবাড়ী প্রায় তিন মাইল দূরে অন্য গ্রাম রণকেলীতে ছিল। আমার মা বেশিরভাগ সময় সেখানে থাকায় আমরা প্রায়ই সেখানে যেতাম। বাড়ীটি মূল রাস্তার পাশে থাকায় তা খুব নিরাপদ ছিলোনা - তাই আমরা সেখানে বেশি দিন থাকতাম না। একবার আমরা সেখানে থাকাকালীন চাঁদপুরের আমার এক স্কুল বন্ধু হঠাৎ আমাদের নানবাড়ীতে উপস্থিত হল। সে ঢাকায় আমার বাবার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে কোনওরকমে রণকেলী চলে আসে। আমরা জানতাম না সে কার পক্ষে কাজ করছে, পাক আর্মি না মুক্তিবাহিনী নাকি সে নিতান্তই একটা ইডিয়ট, কারণ সে বয়সের একটা ছেলে একা ঢাকা থেকে সিলেটের একটা অপরিচিত গ্রামে চলে আসা তাঁর জন্য এবং আমাদের জন্যেও বিপদজনক ছিল। সে বলে যে তাঁর নিজের গ্রামে থাকা তাঁর পক্ষে বিপদজনক তাই সে এখানে চলে এসেছে। তবে সে আমাদের জন্য মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো কারণ সেই বিপজ্জনক সময়ে একটা সিলেটি গ্রামে বাইরের একটা অপরিচিত লোক নানা ধরণের বিপদের কারণ হতে পারে। গ্রামের লোকজন সবাই সবাইকে চেনে এবং তারা কে কোন বাড়ীর বা পরিবারের তাও জানে। যখন কেউ তাঁর পরিচয় জানতে চাইত তখন আমরা খুব অস্বস্তি অনুভব করতাম। আমরা চাইতাম সে চলে যাক কিন্তু তাকে আশ্রয়ও থেকে জোর করে বের করে দেয়াও অমানবিক। অবশেষে সে একদিন চলে গেল এবং আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আমরা যখন রায়গড় ছিলাম তখন একদিন আমরা আমাদের নানাবাড়ী থেকে একটা খুব খারাপ খবর পেলাম যে আমাদের ছোটমামাকে পাক আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। এর আগে গ্রামে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর কয়েকজন বন্ধু জাম গাছে উঠে জাম খাচ্ছিলো সে সময় গাছের নীচ দিয়ে শান্তি কমিটির কিছু সদস্য যাচ্ছিলো, সেই ছেলেরা তাদেরকে জামের বিচি দিয়ে ঢিল মারে এবং তাদের নিয়ে কিছু খারাপ মন্তব্য করে। স্বাভাবিক সময়ে সাধারণত তারা প্রবীণদের কাছে অভিযোগ জানাতো কিন্তু তখন একটা খারাপ সময় চলছিল, লোকেরা একে অন্যের শত্রু হয়ে গিয়েছিলো। তারা গিয়ে পাক আর্মির কাছে অভিযোগ জানায়। পাক আর্মি এসে ছেলেদের কয়েকজনকে ধরে ফেলল, কিন্তু আমার মামা এবং অন্য ছেলেরা পালিয়ে যায়। একজন তরুণ আর্মি অফিসার (ক্যাপ্টেন বা মেজর শরফরাজ, পরে নিহত হয়) এসে আমার প্রবীণ নানাকে বলে যে পরের দিনের মধ্যে ছোট মামা যদি আত্মসমর্পণ না করেন তবে তারা আমাদের নানাকে ধরে নিয়ে যাবে। ইফতেখার জান্ডাল নামে আরও একজন আর্মি অফিসার সেখানে ছিল। তবে তারা আমার নানার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে নাই। তাই ছোটমামা আত্মসমর্পণ করলেন। তাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্যাতন করে এক সপ্তা-দশদিন পর মুক্তি দেয়। সে সময় তাদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, ভাগ্যিস তারা অন্তত বেঁচে ছিলেন।
যেদিন আর্মি আমার নানবাড়ীতে হানা দেয় সেদিন আমি অভিযানের মাত্র দুই ঘন্টা আগে রায়গড়ে যাবার জন্য আমার ছোটভাইকে নিয়ে নানাবাড়ী ছেড়ে যাই যার ফলে আমরা আর্মির হাতে ধরা পড়া থেকে বেঁচে যাই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কয়েকবার মৃত্যুর মুখমুখি হয়েছিলাম। এটি অলৌকিক যে আমি এখনও বেঁচে আছি। আরেকদিনের ঘটনা আমি ও আমাদের নানবাড়ীর একটা লজার ছেলে (মোস্তফা) মূল রাস্তা ধরে হেঁটে ৩ মাইল দূরে রায়গড় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দুটি পাকিস্তানী ফাইটার জেট কোথা থেকে আমাদের দিকে খুব নীচু দিয়ে উড়ে এলো। আমাদের এক সেকেন্ডেরও কম সময় ছিল লুকাবার। আমি ও মোস্তফা এক লাফে পাহাড়ের গায়ে এক গুহায় ঝাপিয়ে পড়লাম। কয়েক সেকেন্ড পরে আমরা খুব কাছেই কোথাও গুলি এবং বোমা ফেলার শব্দ শুনি।
আরেদিন আমার ছোট ভাই এবং আমি একই রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম রণকেলী থেকে ৩ মেইল দূরে রায়গড় যেতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রাস্তা খালি এবং সবকিছুই শান্ত মনে হচ্ছিলো। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তায় বেশী দূর দেখা যেতো না। শুধু এক বাঁক থেকে আরেক বাঁক পর্যন্তই দেখা যায়। হটাত একটা পাহাড়ের বাঁক ধুরেই দেখি আমরা সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে, একদল পাক সেনা আমাদের দিকে মেশিনগান তাক করে আছে।
আমাদের তখন সামনে হাটা ছাড়া কিছুই করার ছিলোনা। পেছন ফিরে দৌড় দেয়া মাত্র ওরা গুলি ছুড়বে - নিশ্চিত মৃত্যু। আমি আমার ভাইকে ফিসফিস করে বললাম "হাঁটতে থাকো, দৌড় দিওনা বা এবং তাদের দিকে তাকিও না"। আমরা যখন তাদের দিকে হাঁটতে থাকি, আমি দেখতে পেলাম যে তাদের সাথে কয়েকজন বাঙালি দালাল ছিল। তারা সৈন্যদের ফিসফিস করে কি যেন বলছিল। স্পষ্টতই, এটি একটা ফাঁদ ছিল এবং সম্ভবত তারা সৈন্যদের বলছিল তারা যাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমরা তা নই। আমরা মনে করেছিলাম যে তারা অন্তত আমাদের থামাবে এবং কিছু প্রশ্ন করবে। কিন্তু তারা কিছুই করেনি, কেবল তাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় আমাদের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম "তারা কি আমাদের পিছন থেকে গুলি করবে?" আমরা যখন পরের বাঁকের আড়ালে গেলাম, তখন মনে হলো যে তারা আর আমাদের দেখতে পাবে না, আমরা নিশ্চিত হতে ফিরে তাকালাম, আমরা তাদের দেখতে পাইনি, তখন আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম, আর পিছন ফিরে তাকাই নি।
জুলাইয়ের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো, বাজার হাট আবার চালু
হল। আমরা আমাদের স্বজনদের দেখতে সিলেট শহরে যেতে পারতাম। ঢাকায় মুক্তিবাহিনী কিছু গেরিলা
অপারেশন চালাচ্ছিল তবে পাক আর্মি অন্তত ঢাকাকে স্বাভাবিক দেখাতে চেয়েছিল। তারা কয়েকটি কলেজ খোলে।
আমার ছোটভাই ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিল।
পাক আর্মি স্কুল কলেজে বিশেষভাবে
সরকারী কর্মচারীদের ছেলেদের গুরুতর পরিণতি এড়ানোর জন্য
উপস্থিত থাকতে বলেছিল। বলেছিল যে যদি কোনও শিক্ষার্থী ক্লাসে
যোগ দিতে ব্যর্থ হয় তবে তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে
ধরে নেওয়া হবে এবং এজন্য তাদের বাবাদের চাকুরী হারানো সহ শাস্তি হবে।
এ অবস্থায় বাবা আমাদের প্লেনে ঢাকায় ফিরে যেতে বলেছিলেন। তখন টিকেট
পাওয়া খুব কঠিন ছিলো। সিলেটের পিআইএ অফিসে কর্মরত আমাদের এক মামার
সহায়তায় আমাদের পুরো পরিবারের টিকিট জোগাড় করতে পেরেছিলাম।
এটি সহজ ছিল না কারণ ঢাকায় যাতায়াতের একমাত্র পরিবহন ছিল প্লেন,
এদিকে দিনে একটা ফ্লাইট এবং হাজার হাজার মানুষ
যেতে চায়। অসংখ্য প্রবাসীরা যারা দেশে এসে আটকা পড়েছিলেন
তারা ফিরে যাবার জন্য উতলা ছিলেন।
রায়গড়ে আমার বড় চাচা একজন দূরদর্শী এবং বাস্তববাদী মানুষ
ছিলেন, তিনি আমাদেরকে বললেন আমরা সবাই যাতে এক প্লেনে
না যাই, কারণ কিছু একটা হয়ে গেলে সারা পরিবার যাতে নিশ্চিহ্ন না হয়। কিন্তু আমরা ভাগ্যক্রমে যে টিকিট
জোগাড় করতে পেরেছি, আবার তা পারবো কিনা তাঁর নিশ্চয়তা
ছিলোনা। আর যদি পরিবার বিভক্ত হয় তবে
আমরা আবার সবাই হয়তো কোনোদিন মিলিত হতে পারব না।
ডেথ ফ্লাইট
ফ্লাইটের দিন পি আই এ অফিস
থেকে আর্মিরা আমাদের একটা বাসে করে এয়ারপোর্ট নিয়ে গেল। সিলেট বিমানবন্দরে পৌঁছে দেহ তল্লাশির জন্য
আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হলো। আমাদের সাথের সব কিছুই তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো। আমার হাতে একটা
রেডিও ছিল। একজন সৈনিক আমার দিকে "ব্যাটারি চেম্বার
খোলো" বলে চিৎকার করল। আমি করলাম এবং সে সব ব্যাটারি ফেলে দিলো। সেখানে একজন মাথা
কামানো তরুণ সেনা অফিসার ছিল। সে আমাদের
দিকে তাকিয়ে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যেন সে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের
মালিক। তারপরে আমাদের এক এক করে প্লেনে উঠার জন্য সৈন্যরা নিয়ে গেলো। আমরা প্লেনে ঢুকার
পর সৈন্যরা আমাদের কোথায় বসতে হবে দেখিয়ে দিচ্ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই সবাই জানালার পাশে বসতে
চেয়েছিলো, কারণ অনেকের জন্যই এটি প্রথম প্লেনে ভ্রমণ ছিল। আমি যখন জানালার পাশের সিটে
যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, তখন একজন সৈনিক আমার কাঁধ ধরে
জোর করে রেগেমেগে "ইয়াহা পার বায়ঠো" বলে আমাকে একটা আইল সিটে বসিয়ে দিলো। প্ল্যানটি চলতে শুরু করতেই, মেশিনগান নিয়ে একজন সৈনিক
যাত্রীদের মুখোমুখি বসে আমাদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছিলো। আমাদের কারো নড়ার সাহস হচ্ছিলনা। বাদাম আর ড্রিঙ্কস তো দূরের কথা,
কেউ টয়লেটে যাবারও সাহস করেনি। কোনও
এয়ার হোস্টেস ছিল না, একমাত্র ছিলো এই বন্দুকধারী।
কেউ যদি একটু সন্দেহজনক নড়াচড়া করতো তবে
সে আমাদের হত্যা করতে প্রস্তুত ছিল। আমি অনুভব করেছি
পিছনে আরও একটা বন্দুকধারী ছিল, কিন্তু কারো মাথা ঘুরিয়ে দেখার সাহস হয়
নি। ৪৫ মিনিটের এই ফ্লাইটটি ছিল ভয়ঙ্কর। কঠোর
নিরাপত্তায় প্ল্যানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলো।
পুরো বিমানবন্দর পাক
আর্মিতে ভর্তি ছিল। বাবা আমাদের নিতে এসেছিলেন এবং আমরা প্রায় ৪ মাস পর বাসায় ফিরে গেলাম।
কলেজগুলো খুললেও ক্লাসে পড়াশুনা তেমন
হতোনা। মুক্তিযোদ্ধারা ক্লাসরুমের ভেতর
গ্রেনেড ছুড়ে মারতো কিন্তু তা বিস্ফোরিত হতোনা। এগুলো বাঙ্গালী
ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করা হতো না বরং
একটা জানান দেবার উদ্দেশ্য ছিল। প্রতিদিন পুরো শহরের নানা
স্থানে বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছিল। সুতরাং ঢাকার পরিস্থিতি মোটেই
স্বাভাবিক ছিল না, যা পাকবাহিনী দাবী করছিলো। আমরা যে সবসময়
মৃত্যুভয় নিয়ে বাস করতাম। কোন কোন
সময় আমরা গুলিস্তান বা নিউমার্কেট যেতে কমলাপুর থেকে বাসে উঠতাম। বাস নিউমার্কেটের কাছাকাছি
আসতে আসতেই প্রায় সারা বাস মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের উর্দুভাষী
যাত্রীতে ভরে যেতো। তারা আমাদের সামনেই ‘মুকুত লোগ’ (মুক্তিবাহিনী) নিয়ে হাসি
ঠাট্টা করতো এবং পাকবাহিনীর সাফল্যের
বীরত্বপূর্ণ গল্প করতো। এছাড়া ‘গাদ্দার’ বাঙালী নিয়ে
কটাক্ষ করতো। তারা জানতোনা আর কয়েক মাস পরেই তাদের উপর কি
ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসবে।
পরের কয়েক মাস মুক্তিবাহিনী তাদের
কার্যক্রম তীব্র করে তোলে এবং দিনে দিনে পরিস্থিতির
অবনতি হচ্ছিল। একদিন রাতে গেরিলারা বাসাবোয়
আমাদের কাছাকাছি এক দালালের বাড়ীতে
বোমা মেরে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে আমাদের বাসার
প্রায় উপর দিয়ে দৌড়ে কাছের ঝিলের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
প্রতি রাতেই কারফিউ ছিল, নভেম্বর মাসের মধ্যেই তারা দিনেও
কারফিউ জারি করা শুরু করে। আমাদের চলাফেরা সীমিত হয়ে গেল। ওরা প্রতিদিন সীমিত সময়ের জন্য
কারফিউটি তুলে নিত এবং আমরা সে সময় প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে খিলগাঁও বাজারে ছুটে যেতাম। সব কিছুর সরবরাহ কম ছিল। রান্না করার জন্য কোনও
জ্বালানী ছিল না। আমাদের সম্বল ছিল একটা ইলেকট্রিক হিটার। ইলেক্ট্রিসিটি এবং পানির সরবরাহ খুব অনিয়মিত ছিল।
পাকবাহিনী সারা শহরে ব্ল্যাকআউট জারি করেছিল। আমরা আমাদের সমস্ত দরজা এবং জানালাগুলিকে
পত্রিকার কাগজ দিয়ে ঢেকে দিলাম যাতে আলোর কোনও ছিটেফোটাও বাইরে
থেকে দেখা না যায় কারণ রাস্তায় টহলরত রাজাকার ও আল-বদাররা কারো বাড়ীর উপর চড়াও হবার জন্য যে কোন একটা ছুতো খুঁজতো।
মৃত্যু-মিছিল
এক গভীর রাতে আমরা
আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তায় অনেক লোকের পায়ের আওয়াজ
শুনে ঘুম থেকে উঠে চুপি চুপি জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে
দেখি রাজাকাররা রাস্তায় প্রায় শতাধিক লোককে তাদের ঘুমের
কাপড় পরা অবস্থায় হাটিয়ে নিচ্ছে। তারা সবাই মুখে দোয়া কালাম
পড়ছিলো। কিছুক্ষণ পরে তারা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা কখনই জানতে
পারিনি তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল সে রাতে।
আরো এক রাতে আমরা রাস্তার অপর
পাশের একটা বাড়ীর দরজায় দুমদুম করে
আঘাত করার শব্দে জেগে উঠি। আমরা ভয়ে ভয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে
তাকিয়ে দেখি রাজাকাররা রাইফেল দিয়ে ঐ
বাড়ীর দরজায় মারছে এবং দরজা খোলার জন্য
চেঁচামেচি করছে। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম যে রাজাকাররা তাদের ভেন্টিলেটর
দিয়ে সামান্য আলো বাইরে আসা নিয়ে তাদের গালাগালি করছে। এটি ছিল শুধুই
একটা অজুহাত, আসল উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট
এবং ধর্ষণ। প্রতিবেশীর ১৬-১৮ বছর বয়সের দুটি সুন্দরী
মেয়ে ছিল। রাজাকাররা তাদের বাড়ী তল্লাশী
করতে চাইছিলো। দরজা খোলা ছাড়া তাদের আর
কোন উপায় ছিল না নইলে রাজাকাররা দরজা ভেঙে ফেলত। তারা যখন
বাড়ীর ভেতরে তল্লাশী করছিলো ও বাবা-মাকে ব্যস্ত রাখছিল ঐ ফাঁকে তাদের মধ্যে কয়েকজন ঐ মেয়ে দুটিকে নিয়ে যায়। রাজাকাররা যখন চলে গেল তখনই মা
বুঝতে পারলেন যে মেয়েরা নাই। তাদের মা পাগলপ্রায় হয়ে কারফিউ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বের হয়ে "আমার
মেয়েদের নিয়ে গেছে, কেউ আমাকে সাহায্য করো, এই শহরে কি আমাকে সাহায্য করার কেউ নাই" বলে চীৎকার করে বিলাপ করছিলেন - কেউ এই
বিলাপে কোন সাড়া দেয় নাই, যদিও পুরো পাড়ার সবাই অন্ধকার থেকে
জানলার ফাঁক দিয়ে সব কিছু দেখছিল। মহিলা রাস্তায় ছুটাছুটি করতে করতে রাজাকাররা যেদিকে গিয়েছিলো সেদিকে ছুটে গেলেন এবং তার ধীরে
ধীরে তাঁর আর্তনাদ ম্লান হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমরা দেখলাম একটা
আর্মি জিপ এসে বাড়ীর সামনে এসে থামল এবং মা ও তাঁর মেয়েরা জিপ থেকে বের হয়ে ঘরে ঢুকলো। জিপটি চলে গেলো
এবং পুরো পাড়াটি আবার শান্ত হয়ে গেলো
যেন কিছুই হয়নি।
পরে আমরা জেনেছি যে যখন তিনি রাজাকারদের পিছু পিছু বিলাপ করছিলেন,
তার চিৎকার শুনে টহলরত একজন দয়ালু পাক আর্মি অফিসার জীপ চালিয়ে তাঁর কাছে এসে জানতে চান কি হয়েছে। এর পর তিনি
মহিলাকে জীপে তুলে নিয়ে তাঁর মেয়েদের উদ্ধার করে তাদের বাড়ীতে পৌঁছে দেন।
অনেক বাড়ীই খালি ছিলো। অনেকেই আসন্ন বিপদ অনুমান
করে সুযোগ থাকতেই আবার গ্রামে চলে গিয়েছিল। মার্চের পর যারা আমাদের মতো গ্রামে চলে
গিয়েছিল তাদের অনেকেই নিজে ফিরে এলেও পরিবার গ্রামেই রেখে এসেছিল। এ কয়মাস আমরা ধীরে
ধীরে ঘরবন্দী হয়ে পড়ছিলাম। আমাদের কিছু আত্মীয় আমাদের পিছনের বাড়ীতে থাকতেন, মাঝখানে একটা নিচু দেয়াল
ছিলো। দুই বাড়ীর পেছনেই বড় বড় গাছপালা ছিলো। এটা আমাদের জন্য
একটা বিরাট সুবিধা ছিলো। ঐ ঘরবন্দী অবস্থায় আমরা সামাজিকতার জন্য পেছনের বাড়ীতে নির্ভয়ে
লোকচক্ষুর আড়ালে নিরাপদে যাতায়াত করতাম।
ক্রমেই শহরের অবস্থা অস্বাভাবিক হতে শুরু করলো।
খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বেরুতোনা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন
বাড়তে থাকলো। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়লো। সবাই বুঝতে পারছিলো
শেষ যুদ্ধটা ঢাকায়ই হবে এবং তা আর বেশী দুরে নয়।
পাক আর্মি যখন বুঝতে পারলো যে তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে যুদ্ধে হারতে চলেছে, তারা ভারতকে প্রকাশ্যে যুদ্ধে টেনে আনতে চেয়েছিল, যদিও ভারত মুক্তিবাহিনীকে পরোক্ষ সহায়তা করছিলো,
কিন্তু তারা সরাসরি জড়িত হয়নি।
মুক্তিবাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ তাদের জন্য বিপর্যয়কর হতো, কারণ মুক্তিবাহিনী কোনও
নিয়মিত বাহিনী ছিল না এবং জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে তারা বাধ্য ছিল না। মুক্তিবাহিনী ও বাঙ্গালীরা তাদেরকে কচুকাটা করে ৯ মাসের
অত্যাচারের প্রতিশোধ নিত। সুতরাং, পাকিস্তান
৩ ডিসেম্বর তারিখে ভারতীয়
বিমানবন্দরগুলিতে বিমান হামলা করে। এতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
পরবর্তী কয়েক দিন ধরে ভারত ঢাকায় নিয়মিত
বিমান হামলা চালিয়েছিল। এটি ছিল আমাদের দিনের বেলার লাইভ বিনোদন।
সবাই যুদ্ধবিমানের ডগফাইট দেখতে ছাদে উঠে যেত। আমরা
ভারতীয় বিমানগুলি দেখে উল্লাস করতাম। একদিন শুনলাম কেউ
নীচের রাস্তা থেকে উর্দুতে চিৎকার করছে “ইয়ে তেরা বাপ কা
প্লেন হ্যায় কেয়া” যার অর্থ “এগুলো কি তোদের বাবার প্লেন?”
রাতের বেলা একটা পাকিস্তানি বিমান বেসামরিক পাড়ায় বোমা ফেলতে শুরু করলো, এমনকি তারা এতিমখানায়ও বোমা ফেলেছিল। পরের
দিন তারা বিদেশী সাংবাদিক ও প্রেস ফটোগ্রাফারদের সেসব জায়গায় নিয়ে দাবি করতো যে এসব
ভারতীয়রা করেছে। এটি ছিলো একটা পুরাতন কার্গো প্লেন,
কোনও ফাইটার জেট নয়। প্রতি রাতে আমরা সেই ‘মৃত্যুদূতের’ আওয়াজ
শুনতে পেতাম আর ভয়ে ভয়ে থাকতাম যে হয়তো পরের বোমাটি
আমাদের উপর পড়বে।
শীঘ্রই এটি স্পষ্ট হয়ে উঠল যে পাক
আর্মি বাসাবোয় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা বহু জায়গায় এবং আমাদের কাছেই
এক উঁচু বাড়ীর ছাদে ভারী কামান বসালো।
তারা মনে করছিল যে মুক্তিবাহিনী শহরের
এই পাশ থেকে অগ্রসর হবে। আমরা অনুভব করলাম যে বাসাবোতে থাকা আমাদের পক্ষে নিরাপদ হবে না। আমাদের এক চাচা শহরের মাঝখানে মতিঝিল কলোনিতে থাকতেন। তারা এপ্রিল মাসে সিলেট যাবার সময় আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি আমাদের বললেন মতিঝিল
কলোনিতে গিয়ে কোনও পরিত্যক্ত অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে
আশ্রয় নিতে। অনেক লোক এভাবে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। একদিন সাময়িকভাবে কারফিউ উঠে যাবার পর আমরা তাড়াতাড়ি কয়েকটা রিকশা নিয়ে মতিঝিল কলোনিতে চলে গেলাম এবং আমাদের চাচার কাছাকাছি একটা পরিত্যক্ত অ্যাপার্টমেন্টে তালা ভেঙ্গে ঢুকে পড়লাম।
আমাদের চাচী আমাদের খুব জোর দিয়ে বললেন যে কাছাকাছি
একটা বিল্ডিংয়ের একটা নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের দিকে আমরা
যেন কখনই না তাকাই কারণ সেখানে এক জঘন্য
বিহারী মহিলা থাকে যে পাকবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখে
এবং সে কলোনীর অনেক ছেলেকে ধরিয়ে
দিয়েছে। অনেকেই আর ফিরে আসে নাই।
১৫ই ডিসেম্বর। আমাদের
থেকে বর্তমান বঙ্গভবন খুব দূরে ছিলোনা। ভারতীয় যুদ্ধবিমান সেখানে বোমা ফেলে, আমাদের
জন্য তা খুবই ভয়ঙ্কর ছিলো। আমরা সেরাতে
ঘুমাতে পারিনি, সকলেই জানত যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, তবে কীভাবে এটি শেষ হবে এবং
আমরা বিজয় দেখতে বেঁচে থাকবো কিনা তা আমরা জানতাম না। জেনারেল নিয়াজী ঘোষণা করেছিল যে ভারতীয়
ট্যাঙ্কগুলি তার শরীরের উপরে না চলা পর্যন্ত সে আত্মসমর্পণ করবে না, যার অর্থ সে আমাদেরকে সাথে নিয়ে মরবে।
সারা রাত আমরা চারদিক
গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা দেখতে পেলাম কিছু রাজাকার এলোমেলোভাবে অনেক বাসার
দরজায় রাইফেল দিয়ে আঘাত করছে। তবে বেশিরভাগ
অ্যাপার্টমেন্ট খালি ছিল। আমরা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম
এবং কখন আমাদের আমাদের দরজায় মারবে সে আতঙ্কে ছিলাম। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম অদুরেই মতিঝিল
বাণিজ্যিক এলাকায় স্টেট ব্যাংকে (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক)
আগুন জ্বলছে। পরে আমরা জেনেছি পাকসেনারা কাগজের নোট পোড়াচ্ছিলো।
শেষ রাতের দিকে রাজাকাররা রাতের আঁধারে মিলিয়ে
গেলো। অবশেষে, ১৬ই ডিসেম্বর দিনটি এলো। ভোর হবার আগেই বহুদূর থেকে আমরা অনেক
লোকের কণ্ঠে খুব ক্ষীণ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পেলাম।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১
অবশেষে, ১৬ই ডিসেম্বর দিনটি এলো। ভোর হবার আগেই বহুদূর থেকে আমরা অনেক লোকের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পেলাম। ধীরে ধীরে তা আরও কাছাকাছি চলে আসছিল। পাক সেনা ইউনিটগুলোকে আত্মসমর্পণ করতে বলার জন্য ভারতীয় বিমানগুলি পুরো শহর জুড়ে লিফলেট ফেলেছে। পাক সেনাবাহিনীও রেডিওতে উর্দুতে ঘোষণা করছিলো “এক জারুরী এলান, সারেন্ডার হোনেওয়ালা হ্যায়, হাতিয়ার ডাল দো” (আমরা আত্মসমর্পণ করতে চলেছি, তোমার অস্ত্র ছেড়ে দাও) সম্প্রচার করছিলো। আমাদের সে কি আনন্দ। কিন্তু মানুষ এত দিন সন্ত্রাসে বেঁচে থাকার পর বাইরে আসতে ভয় পাচ্ছিলো। চারদিকে বন্দুকের আওয়াজ আর বারুদের গন্ধ। পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক ছিল প্রায় হলিউডের মুভিতে দেখা ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মতো।
সেদিন আনন্দ ধরে রাখতে
না পারায় বহু লোক বাইরে বেরিয়ে মারা গিয়েছিল। শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আতঙ্কিত পাক আর্মি ইউনিটগুলি
আত্মসমর্পণ করার জন্য রেসকোর্সে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
তারা সেখানে পৌঁছানোর পথে লোকজন যাতে তাদের ধরতে না পারে তাই এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে ছুটে যাচ্ছিলো। যাকেই কাছাকাছি পেয়েছে
তাকেই গুলি করে মেরেছে। তারা খুব ভাল করেই জানত যে তারা ধরা
পড়লে জনতা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করবে।
আমার বাবা আমাদেরকে কলোনির দেয়ালের বাইরে যেতে নিষেধ করলেন।
কিন্তু আমাদের পক্ষে চারদিকে উঁকিঝুঁকি মারার লোভ সামলানো কঠিন ছিল। আমরা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থেকে আগত লোকদের, হাতে, পকেটে এবং লুঙ্গিতে করে, যে যতটুকু বহন করতে পারে তত পরিমাণ আধাপোড়া পাকিস্তানি নোট নিয়ে আসতে দেখলাম। যেহেতু এসব নতুন নোটের বান্ডিল খুব শক্ত করে প্যাক করা ছিলো তাই সেগুলি পুরোপুরি পুড়ে যায়নি। নোটের বান্ডিলের মাঝখানের নোটগুলি অক্ষত ছিল। বাংলাদেশের নিজস্ব টাকা চালু না হওয়া পর্যন্ত সে পাকিস্তানী নোটগুলো বেশ কিছু সময়ের জন্য বৈধ ছিল।
আমরা হটাত দেখলাম মতিঝিল
আইডিয়াল স্কুলের গেটের ঠিক সামনে একটা ভিড়। আমরা
সাহস করে সেখানে কি ঘটছে তা দেখতে গেলাম। লোকজনের ভিড় ঠেলে মাথা গলিয়ে দেখি সেখানে সেই জঘন্য
বিহারী মহিলার লাশ মাটিতে পড়ে ছিল। মতিঝিল কলোনি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের বন্ধুরা যারা এ
মহিলার শিকার হয়েছিল তাঁর প্রতিশোধ
নিতে কোনও সময় নষ্ট করেনি। দিনের প্রথম দিকেই তারা তাকে তাঁর
বাড়ী থেকে টেনে হিঁচড়ে এনে সেখানে হত্যা
করে। তার বুকের মাঝখানে একটা ক্রিকেট বলের আকারের গর্ত
ছিল।
বারূদ, স্লোগান আর লোকজনের
চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ছিলো, আমরা অবশেষে ৯ মাস ধরে যে সন্ত্রাসের সাথে বাস করছিলাম তা
থেকে মুক্ত হলাম এবং আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা
ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষী হয়ে রইলাম!
১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১
আমার ভাই এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে রাস্তায় জনতার সাথে যোগ দেব।
মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী শহর ঘুরে
বেড়াচ্ছিল। চারদিকে গুলির শব্দ। মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের
দিকে তাদের স্বয়ংক্রিয় বন্দুক থেকে গুলি করছিলো আর
লোকজন তাদের জড়িয়ে ধরছিল। ভারতীয়
সৈন্যরা মোটেই গুলি চালাচ্ছিল না। লোকজন তাদের সাথেও কোলাকুলি করছিল। আমাদের মতোই বেশিরভাগ লোক এর আগে কখনও কোন শিখ দেখেনি, বিশেষত শিখ সৈন্য।
তাদের পাগড়ি এবং বাঁধা দাড়ি লোকজনের মধ্যে অনেক আগ্রহ সৃষ্টি
করে।
বিহারি পরিবার
আমরা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার দিকে গেলাম। মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে পৌঁছে
যেতেই। হঠাৎ চারদিকের গোলমালের মধ্যে আমরা রাস্তার উল্টো
দিকে একটা ব্রাশ-ফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম। প্রচুর লোক সেদিকে ছুটে গেলো, আমরাও ছুটে গেলাম। সেখানে
গিয়ে দেখি কে বা কারা একটা সম্পূর্ণ বিহারি পরিবারকে এই মাত্র
হত্যা করেছে। মনে হচ্ছিলো তারা যেখানে
বাস করত সেখান থেকে নিরাপদ কোথাও পালানোর চেষ্টা করছিল।
কেউ তাদের সনাক্ত করেছে এবং তাদের সবাইকে হত্যা করেছে।
এই দৃশ্যটি খুবই বেদনাদায়ক
ছিল কারণ আমি কখনই আমার চোখের সামনে এরকম হত্যার ঘটনা
ঘটতে দেখিনি। আমি এর সম্পর্কে অনেকবার
খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমি এখনও দেখতে পাই, বিশেষ করে সেই ছোট্ট
মেয়েটিকে, সে তখনও জীবন্ত ছিলো এবং আমি আমার মাথায় তার মৃত্যুযন্ত্রণার গোঙ্গানি এখনো শুনতে
পাই। আমি এ ঘটনা বর্ণনা করার সময়
বাস্তব, কল্পনা এবং স্বপ্ন সব মিলিয়ে যায়।
আমি ভাবি এটা কি একটা দুঃস্বপ্ন নাকি
কোনও ভয়ঙ্কর মুভির দৃশ্য? সেখানে কয়েকটি যুবতী মেয়ে সহ প্রায় ১২ জনের বিহারি পরিবারটি ফুটপাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।
তারপরে একটা খোলা জিপে ফর্সা চেহারার এক
লোক ঘটনাস্থলে এসে দর্শকদের এই দুর্ভাগা পরিবারের যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে তাদের সম্মতি চাইলেন। তখন তিনি একটা চকচকে রিভলবার বের করে মৃতপ্রায় দেহগুলিকে গুলি করা শুরু করলেন। প্রতিটি গুলিতেই
দেহগুলি নড়ে উঠছিল”। আমরা আর সহ্য করতে পারছিলাম না এবং ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে এলাম।
ইন্ডিয়ানা জোন্স
আমার মনে আছে সেই 'ক্লিন-শেভ করা ফর্সা'
লোকটাকে। সে ইন্ডিয়ানা জোন্সের মতো অনুরূপ বেশভুশা, মাথায় একটা হ্যাটও ছিল। যেনো কোন মুভি থেকে উঠে এসেছিল? একজন বাঙালির
তুলনায় সে অস্বাভাবিকভাবে ফর্সা ছিল। তবে সে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেছে। তাকে অন্য কোনও মুক্তিযোদ্ধার মতো
দেখায়নি। খুব ফ্যাশনেবল ছিল; তার জিপটিও চকচকে ছিল। তাঁর রিভলবারটিও ছিল চকচকে রুপালী
রঙের। আমার কাছে তাকে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা মনে হয়নি। গুলি
করে সবাইকে শেষ করে দেবার পর তার জীপ চালিয়ে চলে গেলো। সে এক
ভয়ানক সময় ছিল, কেউ কোন প্রশ্ন
করেনি, কারও কাছে কেউ দায়বদ্ধ
ছিল না। সেই সময় প্রচুর রাজাকার, আল-বদর এবং সহযোগীরা
রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছিলো।
আমরা হাজার হাজার জনতার সাথে শাপলা চত্তর (বর্তমান নাম) থেকে বায়তুল মোকাররমের পাশ
দিয়ে হাইকোর্টের মোড় ঘুরে রমনা পার্ক এর
ভেতর দিয়ে শাহবাগ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড ধরে নিউ মার্কেট পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। রাস্তা সধারণ
লোকজন, মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় সেনা ও
বিদেশী সাংবাদিকে গিজ গিজ করছিলো। গুলির
শব্দ, বারুদের গন্ধ ও কোলাহল চারিদিকে।
বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আসছিল। মাটিতে অসংখ্য খালি বুলেটের শেল পড়ে ছিল। আমরা দেখতে পেলাম খুব স্মার্টভাবে সাজানো একটা
সাদা জীপের উপর নানা রঙের টেইপ দিয়ে 'ক্র্যাক প্লাটুন' লেখা এবং কিছু স্মার্ট পোশাক পরা অস্ত্রধারী শহুরে
গেরিলারা তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মনে হচ্ছিলো যেন তারাও কোনও হলিউড সিনেমা থেকে উঠে এসেছে।
পরে জেনেছি এরা ছিল লেখক জাহানারা
ইমামের ছেলে রুমীর সহযোদ্ধারা। রুমী ছিলেন 'ক্র্যাক প্লাটুন'-এর অন্যতম সদস্য যিনি
বিজয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে শহীদ হয়েছিলেন। এরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেছে।
ফুটপাত এবং রাস্তার
মাঝের আইল্যান্ড এ প্রচুর মৃতদেহ পডেছিল। রমনা পার্কে আমরা এক পাকিস্তানি সৈন্যের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিলাম
যার ডান হাতের কব্জি থেকে কেউ কেটে নিয়ে গেছে। বলাকা সিনেমা হল এবং নিউ মার্কেটের মাঝখানের রাস্তার আইল্যান্ডে বেশ কিছু মৃতদেহ পড়েছিলো।
সে সময়টা অত্যন্ত
বিপজ্জনক সময় ছিল, যে কেউ যে কাউকে
হত্যা করতে পারতো, আইনের ভয় ছিলোনা।
কিছু লোকের জন্য এটি পুরানো বিবাদের প্রতিশোধ নেওয়ার সময়
ও সুযোগ ছিল। পরের কয়েক দিন ছিল সাধারণ মানুষদের ঘরে ফিরে তাদের
স্বাভাবিক জীবন আবার শুরু করার
সময়। জাতি হিসেবে আমাদের আগামী দিনগুলো নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা ছিল, নতুন দেশটি কেমন হবে,
ভারতীয় সেনা কী চলে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সবাই খুশি ছিলাম যে যা হবার হবে, আপাতত যুদ্ধ শেষ এবং আমরা স্বাধীন।